ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক মরণফাঁদে পরিনত

*৮১ দুর্ঘটনায় ১০৫ জন নিহত

খোকন আহম্মেদ হীরা :

ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের ভাঙা থেকে সাগরকন্যা কুয়াকাটা পর্যন্ত মহাসড়কটি সংকুচিত হওয়ায় ভারী যানবাহনের একটি অপরটিকে অতিক্রম করা কষ্টকর হয়ে পরেছে। তার ওপর রয়েছে মহাসড়কে তিন চাকার যানের বেপরোয়া চলাচল। ফলে প্রায় প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

বছরের শুরুতে ২ জানুয়ারি মহাসড়ক দিয়ে বরিশালের প্রবেশদ্বার গৌরনদীর ভুরঘাটা বাসষ্ট্যান্ডে সাকুরা পরিবহনের ধাক্কায় মোটরসাইকেল চালক নিহত ও আরোহী গুরুত্বর আহত হয়েছেন।

এছাড়া ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মহাসড়কের গৌরনদী থেকে উজিরপুরের ইচলাদী এলাকায় ৮১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ১০৫ জন নিহত ও ২২০ জন আহত হয়েছেন। আহতদের মধ্যে প্রায় অর্ধশত ব্যক্তি পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। গৌরনদী হাইওয়ে থানা সূত্রে এসব তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের বরিশালের প্রবেশদ্বার গৌরনদীর ভুরঘাটা থেকে উজিরপুর উপজেলার ইচলাদী পর্যন্ত সড়কটি দীর্ঘদিন থেকে মরণফাঁদে পরিণত হয়েছে। সংকুচিত সড়ক, ফুটপাতে যত্রতত্র দোকানপাট, বেপরোয়াগতির যান চলাচল, তিন চাকার অবৈধ যান চলাচল ও অদক্ষ চালকের কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা লেগেই রয়েছে। আর এতে করে নিহত ও আহতের ঘটনা বেড়েই চলেছে।

গৌরনদী হাইওয়ে থানার ওসি মো. আমিনুর রহমান বলেন, ২০২৪ সালের পহেলা থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মহাসড়কের গৌরনদী থেকে ইচলাদী এলাকায় ৮১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর এসব দুর্ঘটনায় ১০৫ জন নিহত ও ২২০ জন আহত হয়েছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে দুর্ঘটনারোধে ছয়টি সুপারিশ করা হয়েছে।

এসব সমস্যার সমাধান করা না হলে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব নয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

ওসি আরও বলেন, মহাসড়কের গৌরনদী থেকে ইচলাদী পর্যন্ত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হচ্ছে গৌরনদীর বার্থী, টরকী, গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড, আশোকাঠি, মাহিলাড়া, বাটাজোর, উজিরপুরের মোড়াকাঠি, সানুহার, জয়শ্রী ও ইচলাদী। সড়ক সংকুচিতর কারণে এসব এলাকায় তীব্র জানজট লেগেই রয়েছে।

সূত্রমতে, গত ২৯ ডিসেম্বর বরিশাল-ঢাকা মহাসড়কের গৌরনদী উপজেলার বাটাজোরের বাইচখোলা নামকস্থানে যাত্রীবাহী দুটি বাস ও তৈলবাহী লরির ত্রিমুখী সংঘর্ষে একজন নিহত ও কমপক্ষে ২০ জন আহত হয়েছে। দুর্ঘটনার পরপরই মহাসড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে মহাসড়কের দুইপাশের ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তীব্র যানযটের সৃষ্টি হয়েছিলো।

গত ১৫ ডিসেম্বর মহাসড়কের কটকস্থল নামক এলাকার আরিফ ফিলিং স্টেশনের সামনে বরিশালগামী যাত্রীবাহী লাবিবা পরিবহনের ধাক্কায় পথচারী মফিজুল ইসলাম (৭৫) নামের এক বৃদ্ধ পথচারী নিহত হয়েছেন।

বাসযাত্রী নুসরাত জাহান (৩২) অভিযোগ করে বলেন, চলন্ত অবস্থায় বাসচালক মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন।

বাসযাত্রীরা চালককে কথা বলতে নিষেধ করায় তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে গৌরনদী আরিফ ফিলিং স্টেশন এলাকায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রীদের সাথে খারাপ আচরণ করেন। পরবর্তী সময়ে বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মহাসড়কের পাশের একটি ভ্যানকে ধাক্কা দিয়ে দোকান ভেঙে ডোবায় পড়ে যায়।

এর আগে গত বছর (২০২৪ সালে) সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছিলো মহাসড়কের উজিরপুর উপজেলার বামরাইল এলাকায়। চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মেহগনি গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে ঘটনাস্থলেই ১০ জন ও হাসপাতালে একজনসহ মোট ১১ জন নিহত ও ২০ জন আহত হয়েছিলো।

ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা ভান্ডারিয়াগামী নৈশকোচ যমুনা পরিবহনের চালক ঘুমিয়ে পড়লে বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের পূর্ব পাশে মেহগনি গাছের সাথে ধাক্কা খেয়ে দুমড়ে মুচড়ে যায়।

দুর্ঘটনায় নিহত একজনের স্বজন ফারুক হোসেন বলেন, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর কারণে প্রতিনিয়ত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। অথচ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। মহাসড়কে দুর্ঘটনারোধে কার্যকরী কোন পদক্ষেপও গ্রহণ করা হচ্ছেনা।

সূত্রমতে, ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের সাথে সড়কপথে যোগাযোগের একমাত্র প্রবেশপথ ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক পরিণত হয়েছে দুর্ভোগের সড়কে। সারাদেশের অন্য মহাসড়কগুলোতে একাধিক লেন থাকলেও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক একলেন বিশিষ্ট।

এছাড়া এই মহাসড়কে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে ধীরগতির অবৈধ যানবাহন। এতে করে বাড়ছে দুর্ভোগ। সড়ক ব্যবহারকারীদের দাবি দ্রæত সময়ের মধ্যে এই মহাসড়কে ধীরগতির যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং সেই সাথে এই মহাসড়ক একাধিক লেনে উন্নীত করতে হবে।

সড়ক বিভাগের তথ্যানুযায়ী, এই মহাসড়কে প্রতিদিন ১৮ হাজার গাড়ি চলাচল করে। যাত্রীদের অভিযোগ, মহাসড়ক সরু এবং ধীরগতির অবৈধ যানবাহনের কারণেই এই দুর্ভোগের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে যাত্রীর নষ্ট হয়েছে কর্মঘণ্টা। বেড়েছে দুর্ভোগ।

ব্যস্ততম এই সড়কে প্রতি মিনিটে যাওয়া-আসা করে বিভিন্ন যানবাহন। সড়ক সরু এবং চলছে ধীরগতির অবৈধ যানবাহন। এতে করে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে সড়কে চলাচল করতে হচ্ছে। এ কারণে মহাসড়ক এখন মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল থেকে মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়কটি মাত্র ১৮ থেকে ২৪ ফুট প্রশস্ত। এরমধ্যে অনেকস্থানে মহাসড়কটির অবকাঠামোগত অবস্থা খুবই নড়বড়ে।

১৯৬০-৬৫ সালের মধ্যে মাত্র পাঁচ টন বহন ক্ষমতা সম্পন্ন ১২ ফুট প্রশস্ত মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়। এরপর বিগত ৬০ বছরে দুই পাশে আরও ৬ থেকে ১০ ফুট প্রশস্ত করা হলেও বহন ক্ষমতা আর বাড়েনি। অথচ যানবাহনের চাপ বেড়েছে কয়েক শতগুণ। ফলে বেড়েছে দুর্ভোগ।

সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বরিশাল হয়ে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা পর্যন্ত মহাসড়কটি ছয়লেনে উন্নীত করার সরকারি সিদ্ধান্ত হয়। পরে ২০১৮ সালে ভূমি অধিগ্রহণে সরকার অর্থ ছাড় করে।

পাশাপাশি প্রস্তাবিত ছয়লেন মহাসড়কের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও নকশা প্রণয়নে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়। কিন্তু পরামর্শক চূড়ান্ত নকশা জমা দিলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

পাশাপাশি ভূমি অধিগ্রহণ কাজ সম্পন্ন করার মেয়াদ ২০২০ সালে নির্ধারিত থাকলেও ২০২৪ সালে এসেও তা আলোর মুখ দেখেনি। একইসাথে দাতার অভাবে প্রকল্পটি স্থবির অবস্থায় পরে থাকে। ফলে এ মহাসড়কটি ছয়লেনে উন্নীতকরণের কাজ কবে নাগাদ শুরু হবে তা কেউ বলতে পারছেন না।

একইসাথে অপ্রশস্ত ও নড়বড়ে মহাসড়কে অনিয়ন্ত্রিত গতির যানবাহন দুর্ঘটনায় প্রাণহানীর ঘটনা বেড়েই চলেছে।

সচেতন বরিশালবাসী মনে করছেন, ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের ভাঙা থেকে সাগরকন্যা কুয়াকাটা পর্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ সড়কটি ছয়লেনে উন্নতী করা না হলে কোনক্রমেই সড়ক দূর্ঘটনা কমানো সম্ভব হবেনা। তাই অনতিবিলম্বে জনগুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটি ছয়লেনে উন্নতী করার জন্য সংশ্লিষ্ট উধ্বর্তন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *