অপসারণের চাপ থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্যে আপাতত রাষ্ট্রের প্রধানের পদ ছাড়তে হচ্ছে না রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে।

অপসারণের চাপ থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্যে আপাতত রাষ্ট্রের প্রধানের পদ ছাড়তে হচ্ছে না রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে। অপসারণ কিংবা পদত্যাগ করলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে- এমন আশঙ্কা থাকায় এখনই বঙ্গভবন ছাড়তে হচ্ছে না বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে। যদিও তাঁকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ এখনো রয়েছে। রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে বেশ অস্বস্তিতে থাকলেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তরফে স্পষ্ট করেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, রাষ্ট্রপতির পদচ্যুতির প্রশ্নে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে রাজনৈতিক ঐকমত্য পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। 
গত সপ্তাহ ধরে রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবির ইস্যুতে নানা মহলে আলোচনা চলছে, তেমনি আইনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও। তবে রাষ্ট্রপতির পদচ্যুতির বিষয়ে রবিবার অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান আবারও স্পষ্ট করেছেন বন ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। সচিবালয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের এ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির পদচ্যুতির প্রশ্নে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, এটা একটা বড় সিদ্ধান্ত। এটাতে আমাদের যেমন তাড়াহুড়া করার সুযোগ নেই, তেমনই অতিরিক্ত বিলম্ব করার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক ঐকমত্য যেহেতু গড়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, ওইটা পর্যন্ত আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির বিষয়টা এমন- এখানে গোপনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই। যখন একটা সিদ্ধান্ত হবে, সেটা হবে প্রকাশ্য।

এখন রাজনৈতিক ঐক্য যত তাড়াতাড়ি হবে, তার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। সিদ্ধান্ত কী হবে- তা আমরা বলতে পারব না। কারণ রাজনৈতিক ঐক্য কোনদিকে যাবে, মতামত কোনদিকে বেশি যাবেÑসেটা তো আমি বলতে পারব না। এ মুহূর্তে কারো পক্ষে অনুমান করাও সম্ভব নয়।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ বলে একটা কথা আছে। এটা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত একটি মতবাদ, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা ছিল আমাদের একমাত্র অপশন। বিএনপি বলছে, তারা রাজনৈতিক সংকট দেখছে; আবার বিএনপিরও দুই-এক নেতা বলছেন, তারা সে সংকট দেখছেন না। এখন যারা দাবি করছেন, তাঁর (রাষ্ট্রপতি) অপসারণ দরকার এবং যারা বলছেন এটা হলে রাজনৈতিক সংকট হবে- মূলত ঐক্যটা তাদের মধ্যে করার চেষ্টা করা হচ্ছে। 
এদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার থেকে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কথা বলা হলেও দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এ ইস্যুতে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। অপরদিকে রাষ্ট্রপতি পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন মত দিলেও তাঁর পদত্যাগ প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামীর জোরালো দাবি নেই। 
রবিবার দলীয় এক কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বিএনপির মহামচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রাষ্ট্রপতি অপসারণ ইস্যুতে সরকারকে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সবকিছু সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
রাষ্ট্রপতির অপসারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আপনাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে, এ বিষয়ে বিএনপির অবস্থান কী জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপির যে সর্বোচ্চ ফোরাম রয়েছে, সেই ফোরামে আলোচনা হবে। আলোচনা শেষে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করব। তবে আমরা এর আগেও বলেছি, গণঅভ্যুত্থানের ফসল ঘরে তোলার জন্য বাংলাদেশের বিপ্লবকে সংহত করতে হবে, কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় হওয়া উচিত। তার জন্য বেশি প্রয়োজন অতিদ্রুত নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়া। 
রবিবার রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ দেশে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে অভিযোগ করে বলেছেন, নানা ধরনের সাংবিধানিক সংকট যদি হয়, রাষ্ট্রীয় সংকট যদি হয়, রাজনৈতিক সংকট যদি হয়, সেই সংকটের পেছনে কী শক্তি আছে- সেটা আমাদের আগেই পর্যালোচনা করতে হবে। 
গত বুধবার বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় গিয়ে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এ মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে ‘নতুন সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক জটিলতা’ সৃষ্টির বিপক্ষে দলীয় অবস্থানের কথা জানান। তবে ওইদিন সন্ধ্যায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিএনপির এই অবস্থান প্রত্যাখ্যান করে পাঁচ দফা দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যুতে দফায় দফায় বৈঠকও করে যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পদে মো. সাহাবুদ্দিন কত সময় টিকে থাকতে পারবেন, তা নিয়ে এখনই নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না। 
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে সাংবিধানিক জটিলতার মধ্যেও এই পদে নতুন মুখ খুঁজতে নানামুখী তৎপরতা চালানো হয়েছিল। ছাত্রনেতাদের অধিকাংশ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে রাষ্ট্রপতির পদে আনতে চাইলেও সরকারের পক্ষ থেকে বিকল্প ব্যক্তিরও সন্ধান করা হয়। এ ছাড়া নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে একাধিক গ্রহণযোগ্য সাবেক প্রধান বিচারপতির নাম নিয়েও রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন রয়েছে।  
বিএনপি-জামায়াতের দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের প্রতি বিশেষ কোনো অনুকম্পা বা সহানুভূতি তাদের নেই। তবে এই ইস্যুতে এই মুহূর্তে দেশে সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হোক, এটা চায় না বিএনপি। বিষয়টি নিয়ে দলের অবস্থান সম্পর্কে জামায়াতের নেতারা বলছেন, রাষ্ট্রপতি মিথ্যাচার করে শপথ ভঙ্গ করেছেন, তাঁর পদে থাকার নৈতিক অধিকার নেই। রাষ্ট্রপতির অপসারণ চান কি না প্রশ্ন করা হলেও তারা শুধু এটুকু বলেছেন, এটা আমাদের চাওয়ার বিষয় নয়। রাষ্ট্রপতি পদে থাকার অধিকার তিনি হারিয়েছেন। 
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা নানা অনুষ্ঠানেই স্পষ্ট করে জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশে এখন যে সাংবিধানিক কাঠামো, তাতে এই সময়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ বা তাঁকে ইমপিচমেন্টের (অভিশংসন) কোনো সুযোগ নেই। সংসদ না থাকা, স্পিকারের পদত্যাগ ও ডেপুটি স্পিকার কারাগারে থাকায় এই সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়েছে। 
তারাও আরও বলেছেন, সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে জটিলতা আছে। কারণ, সংবিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যরা তাঁকে (রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন) নিয়োগ দিয়েছেন। এখন তাঁর নিয়োগকারী সংসদই তো নেই। এখন তিনি তাঁর পদত্যাগপত্র কোথায় পাঠাবেন? তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার কোনো কর্তৃপক্ষও নেই। আবার অন্তর্বর্তী সরকার, যাঁদের তিনি (রাষ্ট্রপতি) নিয়োগ দিয়েছেন, তাঁরা কীভাবে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ গ্রহণ করবেন? তবে এখন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করবেন কি করবেন না এটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। যেহেতু সংবিধানে সুযোগ নেই। তাই রাজনৈতিক দলসহ সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে এটা হতে পারে। পরের সংসদ এসে এর বৈধতা দেবে। 
বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন স্পিকার নেই, ডেপুটি স্পিকারও নেই। ফলে রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন। এখানে একটা শূন্যতা আছে। এই ক্ষেত্রে একমাত্র পথ হলো ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’। নেসেসিটি এটাকে লিগ্যাল করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলার যে রায় আছে, সেখানে এই কথাই বলা হয়েছে। আর রাষ্ট্রপতিকে অভিসংশনের কোনো সুযোগ  নেই। যেহেতু পার্লামেন্ট (সংসদ) নেই। পার্লামেন্ট ছাড়া তো আর অভিশংসন হবে না। 
প্রসঙ্গত, গত রবিবার দৈনিক মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মন্তব্য ঘিরে দেশজুড়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়। আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল সোমবার রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ করেন। বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করা হয়। ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যেও। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগসহ পাঁচ দফা দাবি জানিয়ে সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *